top of page

সেশেলস: আফ্রিকার স্বর্গদ্বীপের রহস্য

  • Writer: Travelograph Partsunknown
    Travelograph Partsunknown
  • Aug 4
  • 4 min read

Updated: Aug 5

ইথিওপিয়ার এডিস আবাবা এয়ারপোর্টে বোর্ডিং গেটের লাইনে দাঁড়িয়ে আছি শারমীন আর আমি। আমাদের একসঙ্গে ভ্রমণের ১১১তম দেশ ইথিওপিয়া। এখান থেকে আমরা যাব সেশেলস (Seychelles) দ্বীপপুঞ্জে। ভারত মহাসাগরে, আফ্রিকা মহাদেশের উত্তর-পূর্বে এই দ্বীপপুঞ্জের অবস্থান।


লাইনে আমাদের পেছনেই অল্প বয়সি এক দম্পতি। রূপবতী আর সুপুরুষ দুজনকে দেখলেই বোঝা যাচ্ছে এ মুহূর্তে পৃথিবীর সর্বসুখ তাদের ওপর অর্পিত। বোর্ডিং গেটের চারপাশটায় প্রচুর মানুষের সমাগম। জীবনের রোমান্টিকতা তাদের যেন এখন তুঙ্গে। এদিক-ওদিক মানুষ ঘুরে ঘুরে দেখছে, কারও মুখে বিস্ময়, কারও মুচকি হাসি, আমি ভাবছি আমাদের গায়ের ওপর এসে না পড়লেই হয়। তাদের অবস্থান ঠিক আমাদের পেছনেই। একটু পরেই জানা গেল তারা দুজন যাচ্ছেন মধুচন্দ্রিমায়।

ree

পৃথিবীতে নববিবাহিত দম্পতিরা মধুচন্দ্রিমায় যে তিনটি স্থানে যেতে চায় তার মধ্যে সেশেলস দ্বীপপুঞ্জ অন্যতম। বাকি দুটি স্থান বোরা বোরা দ্বীপপুঞ্জ, অন্যটি মালদ্বীপ। যাই হোক লাইনের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা নতুন দম্পতি ঠিক জায়গা মতোই যাচ্ছেন। আমরা যাচ্ছি পৃথিবীতে অন্য এক প্রান্তে পা ফেলার জন্য। ভ্রমণের নেশায়, নতুন গন্তব্যে ছুটে চলা। সেশেলসের প্রতিটি কোনায় লুকিয়ে আছে সৌন্দর্যের এক নিঃশব্দ গল্প, প্রকৃতির এক নিজস্ব সৃষ্টি এখানে। নীল আকাশের নিচে স্বচ্ছ সমুদ্রের ঢেউ ঝিকিমিকি, সোনালি বালু শিল্পের মতো ছড়িয়ে থাকা, সবুজ পাহাড় আর নীল সমুদ্রের মিলন। আর নির্জনতা এখানকার বৈচিত্র্য।


দুপুর পেরিয়ে আমাদের ফ্লাইট নামল সেশেলস দ্বীপপুঞ্জে। আমরা এসেছি মাহে দ্বীপে। এটাই মূল দ্বীপ। সেশেলসে ছোট-বড় মোট দ্বীপের সংখ্যা ১১৫। এয়ারপোর্ট খুব ছোট, অল্প সময়ে ইমিগ্রেশন কাস্টমস শেষ করে বাইরে বেরোতেই অপেক্ষা করেছে রেন্টাল কার কোম্পানির এক ভদ্রলোক। আমাদের একটা ছোট গাড়িতে করে নিজেরাই আগামী কয়েক দিন এই দ্বীপে ভ্রমণ করব। দ্বীপের পথগুলো সরু, হয় সাগরঘেঁষা, নয়তো পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ। যদিও পথ অত্যন্ত সুন্দর, তবে ড্রাইভিং করার সময় বেশ সতর্ক থাকতে হয়। কারণ রাস্তাগুলো সংকীর্ণ, হঠাৎ বাঁক এবং খাড়া ঢাল দিয়ে পূর্ণ। বিশেষ করে যারা পাহাড়ি রাস্তায় অভ্যস্ত নন, তাদের জন্য এটি চ্যালেঞ্জিং মনে হতে পারে। ঘণ্টাখানিকের পথ পাড়ি দিয়ে আমরা পৌঁছালাম দ্বীপের অন্যপাশটায়। এখানেই আমাদের রিসোর্ট; নাম কনস্ট্যান্স এফেলিয়া (Constance Ephelia), প্রায় ৩০০ একর বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়ে মাহে দ্বীপের পশ্চিম পাশটায় এই রিসোর্টের অবস্থান। অনায়াসেই এখানে কাটিয়ে দেওয়া যায় বেশ কয়েক দিন।

ree

ভ্রমণে আমাদের ঘুম ভাঙে বেশ সকালে। এর মূল কারণ আগের রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমাতে চলে যাওয়া। শেষ ভ্রমণে গিয়ে রাতে কবে টিভি অন করেছি মনে নেই। নতুনত্বের কাছে যাওয়াই তো ভ্রমণ, কী প্রয়োজন এখানে পিছুটানের, কী প্রয়োজন সারা বিশ্বকে হাজির করা? সকাল হওয়ার আগেই চারপাশটায় শুরু হয় পাখির চেঁচামেচি, হঠাৎ সব জেগে ওঠে যেন। নিজে জাগলেই নয়, বাকি সবাইকে চিৎকারে তুলে দিতে হবে। পাখির সেই ঘুমভাঙা কোলাহল শহর জীবন থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই জগৎ তাদের, আমরা এসেছি বেড়াতে তাদের জগতে। সকালের নাশতা শেষ করেই বেরিয়ে পড়লাম। আজ সারা দিন রিসোর্টের ভেতরেই কাটাব। পাহাড়টা পেরিয়ে হাইকিং করে নিচে নেমে যাব নরম বালুকণার সৈকতে। বসে থাকব কোনো কারণ ছাড়া, হাঁটব এলোমেলো। কখনও নেমে যাব পানিতে। চারপাশটা ফাঁকা, কেউ নেই। এ যেন এক বিচ্ছিন্ন জগৎ, শুধুই আমাদের। শান্ত সমুদ্রের গর্জন আর নরম বালুর স্পর্শে এখানে মনে হয় সময় থেমে গেছে।


পরদিন গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম দ্বীপের আঁকাবাঁকা পথ ধরে। কিছু জায়গায় থামব। জায়গাগুলো আগে থেকেই ঠিক করা। এখন ভ্রমণ মানেই দেখার চেয়ে বেশি ছবি তোলা, আমিও তার বাইরের কেউ নই। ঘর ছেড়ে যখন বের হই; সঙ্গে থাকে বিভিন্ন ধরনের ফটোগ্রাফির সরঞ্জামাদি। থাকুক সঙ্গে সব, যখন গন্তব্যে পৌঁছাই সব ফেলে রাখি হোটেলের কামরায়। ভ্রমণে ইলেকট্রনিকসের বোঝা টানতে ভালো লাগে না, শুধু ফোন হাতে নিয়েই বেরিয়ে পড়ি। শুধু ফোন ব্যবহার করি ভ্রমণ অভিজ্ঞতাকে ধরে রাখার চেষ্টায়।

ree

১৬ বছর ধরে শারমীন আর আমি একসঙ্গে ভ্রমণ করি, অগণিত ছবি তুলেছি আমি। মাঝেমধ্যে আমি শারমীনকে বলিÑ প্রতি ছবিতে এক টাকা করে দিলেও এখন আমি কোটিপতি হয়ে অবসরে যেতে পারি। তার কথা- আমি তো ছবি তুলতে বলি না। তুমিই এইভাবে, ওইভাবে ছবি তুলতে হবে বলে বলতে থাকো। কথা ঠিক, আমিই বলি, শখটা আমারই। নিজে প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার, আমি না। তবে দেখতে দেখতে যা ভালো লাগে তাই নিয়ে আসি সঙ্গের ফোন ডিভাইসে।


আফ্রিকার পূর্ব উপকূলে অবস্থিত ভারত মহাসাগরের বিখ্যাত দ্বীপপুঞ্জ সেশেলস স্নরকেলিং, ক্যানোইং, মাছ ধরা এবং স্কুবা ডাইভিংয়ের জন্য বিখ্যাত। হাজার হাজার প্রজাতির মাছ এবং কচ্ছপ দেখতে পাবেন এখানে। এটিকে বিবেচনা করা হয় বিশ্বের প্রাচীনতম এবং সবচেয়ে শক্ত গ্রানাইট দ্বীপপুঞ্জ হিসেবে। জীববৈচিত্র্যই সেশেলসকে বিখ্যাত করে তুলেছে। এখানে এমন অনেক গাছপালা আর পশুপাখি পাওয়া যায়, যা পৃথিবীর আর কোথাও পাওয়া যায় না। ব্লু পিজিয়ন, হোয়াইট আই, হোয়াইট-টেলড ট্রপিকবার্ড, কত ধরনের পাখি আছে এখানে। পক্ষীবিশারদদের কাছে সেশেলস একটা নিজস্ব জগৎ। বিখ্যাত জীববিজ্ঞানী লিন্ডসে চং সেং বলেন, ‘আমার কাছে ওটাই আসল। আমি এই “এন্ডেমিক্স”, মানে যে গাছপালা, পশুপাখি শুধু এখানেই পাওয়া যায়, তাদের দেখতে ভালোবাসি। আমাদের কী সম্পদ আছে, সেটা বোঝার আগে, সে সম্পর্কে জানা চাই। এসব জীবের মধ্যে অনেকগুলোই এতটা “ক্রিপ্টিক”, মানে গোপন বা ছদ্মবেশী, যে শুধু বিশেষজ্ঞরাই তাদের সম্পর্কে জানেন। আমি এই বিরল প্রাণীদের পরিচিত করে তোলার চেষ্টা করছি।’ সারা দেশেই প্রকৃতি সম্পর্কে এই সচেতনতা আছে। সেশেলসই বিশ্বের প্রথম দেশ, যারা প্রকৃতি সংরক্ষণকে তাদের সংবিধানের অংশ করে। কয়েকটি এলাকা পুরোপুরি সংরক্ষিত, বিশেষ করে সমুদ্রবক্ষে।

ree

কোরাল রিফ বা প্রবাল প্রাচীরগুলো নষ্ট হতে শুরু করার পর তাদের একটা বড় অংশ আবার কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠেছে– বিশেষ করে একটি প্রকল্পের কল্যাণে। ভেঙে যাওয়া প্রবালগুলোকে জলের তলাতেই এক ধরনের বিশেষ আঠা দিয়ে সেঁটে দেওয়া হচ্ছে। চারশ বছর আগে যেসব নাবিক আর মাল্লা সেশেলস দ্বীপপুঞ্জে প্রথম পা দিয়েছিলেন, তাদের থেকে শুরু করে আজকের হলিউড স্টার– সেশেলসের প্রেমে পড়েননি, এমন কেউ আছেন কি? এখানকার প্রকৃতি এমনই মুগ্ধ করে সবাইকে। 


ভ্রমণ একসঙ্গে আমাদের দুজনকে নিয়ে এসেছে অনেকটা পথ। ভালো থাকার মূলমন্ত্র হয়তো ভ্রমণে। মাঝেমধ্যে নিজেই মুগ্ধ হয়ে পুরনো সব ছবি আর ভ্রমণ ভিডিও ক্লিপগুলো দেখি। হুট করে ফিরে যাই সেই সময়ে, সেই স্থানে, মনে পড়ে ঘটে যায় অনেক ঘটনা। মাঝেমধ্যে মনে হয়, আমি তো দীর্ঘদিন ধরে যেন বেঁচে আছি, এত ঘটনাপ্রবাহ, এত জায়গায় ঘোরাঘুরি, অবাক হয়ে ভাবি।

ree

আমার জানা মতে, এই পৃথিবীতে একজন মানুষ সব হারাতে পারে, চুরি হয়ে যেতে পারে সব। শুধু অর্জন করা অভিজ্ঞতাটুকুই থেকে যায় সঙ্গে। এখন থেকে একশ বছর পরে; আমি, আমরা, আমাদের চারপাশের পরিচিত কেউই থাকবে না। আমার হাতে তোলা কোটি ছবি হারিয়ে যাবে। হারাবে এই লেখা, এই অভিজ্ঞতা। শত বছর পরে আরেকটি ফ্লাইট তৈরি হবে সেশেলস দ্বীপপুঞ্জে যাওয়ার জন্য। কী প্রচণ্ড উত্তেজনা নিয়ে আবার কোনো নববিবাহিত দম্পতি ফ্লাইটে ওঠার লাইনে দাঁড়াবে। ছেলেটা ঢলে পড়বে মেয়েটার গায়ে। এই তো পৃথিবী, এই তো চক্র, সেই চক্রে তুমি আমি সবাই শুধু ঢুকব আর বের হবে, হারিয়ে যাব।

ভ্রমণ দিয়েছে অনেক। কখনও ভাবিনি বিশ্ব দেখার নেশায় আমাদের পেয়ে বসবে। আমরা দুজন ‘কী আছে দুনিয়ায়’ দেখায় নেশাগ্রস্ত। সেশেলস দ্বীপপুঞ্জ পৃথিবীর মানচিত্রে খুঁজে পাওয়া কঠিন। ভারত মহাসাগরে, আফ্রিকার উত্তর-পূর্বে প্রকৃতি নিখুঁতভাবে লুকিয়ে রেখেছে এই দ্বীপপুঞ্জকে। আমি শুধু বাকিটা জীবন জানব, আমরা গিয়েছিলাম সেখানে, জীবনের কিছুটা সময় আমাদেরও থমকে দাঁড়িয়ে ছিল এই দ্বীপপুঞ্জে।


 
 
 

Comments


bottom of page