গ্যালাপাগোস : আমরা স্বর্গ থেকে আসিনি, স্বর্গেই আছি
- Travelograph Partsunknown
- Aug 15
- 5 min read

আমরা মানুষ, প্রকৃতির ক্ষুদ্র এক অংশ। সৃষ্টিরহস্য আমরা কীভাবে ভাবতে চাই, বা ভাবতে ভালো লাগে তা দিয়ে প্রকৃতির কিছু যায় আসে না। প্রকৃতি চলছে তার নিয়মে, সাপ লুডু খেলছে। আমরা খেলাটা দেখছি, বোঝার চেষ্টা করছি। যুগ যুগ লেগে যাচ্ছে প্রকৃতির একটা লেয়ার বা আস্তরণ উন্মোচন করতে। খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, ১৮৩১ সালে ব্রিটিশ রয়্যাল নেভি থেকে এক জাহাজ বের হয়ে পড়ল দক্ষিণ আমেরিকাসহ কিছু ভূখণ্ডের মানচিত্র তৈরির কাজে। জাহাজে উঠলেন একজন প্রকৃতিবিজ্ঞানী। তাঁর কাজ বিভিন্ন জায়গা থেকে বিভিন্ন প্রাণীর নমুনা সংগ্রহ করা। পাঁচ বছর তিনি জাহাজে ঘুরে বেড়িয়েছেন। দক্ষিণ আমেরিকার ইকুয়েডর দেশের পশ্চিমে প্রশান্ত মহাসাগরে কিছু দ্বীপপুঞ্জ। নাম গ্যালাপাগোস। ভিন্ন ভিন্ন দ্বীপে একই প্রাণীর মাঝে তিনি কিছু তফাৎ দেখলেন। মেলাতে পারছিলেন না কেন এই ভিন্নতা। তিনি দেখলেন, বোঝার চেষ্টা করলেন। সমুদ্রযাত্রা শেষে তিনি লিখলেন "দা অরিজিন অফ স্পিসিস", প্রকাশিত হলো।

পৃথিবীতে আধুনিক মানুষের অবস্থান প্রায় দুই লক্ষ বছর। এই দীর্ঘ লম্বা সময় পেরিয়ে প্রথম একজন মানুষ প্রকৃতির সাপ লুডু খেলার কৌশল কিছুটা ধরে ফেললেন - প্রকৃতিতে প্রাণের বিবর্তন হচ্ছে প্রাকৃতিক নির্বাচনের ধারায়। শত সহস্র বছর মানুষ একই প্রশ্ন করে যাচ্ছে - আমি কোথা থেকে এলাম? কেন এলাম? কোথায় যাচ্ছি? এই সবটুকুর খানিকটা উত্তর মিলে গেল। আমি কোথা থেকে এলাম, তা জানা হলো, কিন্তু গ্রহণযোগ্যতা পেল না। পৃথিবী তখন ধর্মের ছায়ায় আশ্বস্ত। আমরা ঈশ্বরের তৈরি, সেখান থেকেই শুরু। প্রচলিত সব ধর্মগ্রন্থে সেভাবেই বলা আছে। গ্রন্থের সেই লেখা খুব সহজ। কেউ শুরু করে দিয়েছেন, সেখান থেকেই চলা। এর মধ্যে পেছনের কোনো গল্প নেই, কোনো উত্তর নেই, প্রশ্ন করা এখানে তীব্রভাবে নিষিদ্ধ।
এরই মাঝে "দা অরিজিন অফ স্পিসিস" আর তার লেখক চার্লস ডারউইন আঙ্গুল ঢুকিয়ে দিলেন। বলা হলো মানুষের পূর্বপুরুষ আর বানরের পূর্বপুরুষ একই প্রাণী থেকে আসা। সেই প্রাণের বিলুপ্তি ঘটেছে। বিবর্তনের শাখায় একপাশে মানুষ, অন্যপাশে বানর। জীববিজ্ঞানের সূত্রে মানুষ আর বানর চাচাতো ভাই। তখন গির্জার এক বিশপের স্ত্রী স্বামীকে ডেকে বললেন "ওগো প্রিয় বানর প্রজাতি স্বামী, আশা করি এ কাহিনী সত্য নয়। আর যদি হয়েও থাকে, প্রার্থনা করি তা যেনো বাইরের জগতের কেউ না জানে।"
তারপর ১৬৪ বছর পার হয়ে গেছে। মানুষের জানার শাখায় প্রশাখায় প্রতিটা বিন্দুতে প্রকৃতির এই সাপ লুডু খেলা স্পষ্ট। মানুষ দেখছে, জানছে, অসংখ্য বিন্দু পড়ে যাচ্ছে একই সরল রেখার ওপর। একবিংশ শতাব্দীতে পৃথিবীতে এমন কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নেই যেখানে প্রাণীর বিবর্তনকে অস্বীকার করা হয়। বিজ্ঞান ধাপে ধাপে জমা করেছে বিবর্তনের প্রমাণ।

কয়েকটি শাখায় বিবর্তন নিয়ে অধ্যয়ন হয়। এর মাঝে আছে দৈহিক গঠনতন্ত্র, জীবাণুবিজ্ঞান, জৈব ভূগোল, জীবাশ্ম, প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ। বিষয়বস্তু, তথ্য, গবেষণা ও পর্যবেক্ষণ এর কোনোটাই খুব সহজ বোধগম্য নয়। ডারউইন যা বলেছিলেন সেটা ছিল পর্যবেক্ষণ থেকে একটা থিওরি। সহজ নয় বলেই সময় লেগেছে ১৬৪ বছর। হাজার লক্ষ মানুষের মেধার আর তথ্যের ওপর ভর করে আজ জানা হয়ে গেছে পৃথিবীর প্রতিটা প্রাণী একে অন্যের সাথে সরাসরি যুক্ত। প্রায় ৩৭০ কোটি বছর আগে এককোষী প্রাণ থেকেই শুরু আজকের চেনা জানা প্রতিটি প্রাণের।
এক দীর্ঘ সময় পার করে একজন মানুষ, চার্লস ডারউইন যা দেখলেন তা তাঁর আগে কেউ দেখল না? কী অদ্ভুত, কী সুন্দরভাবে বর্ণনা করা হলো - আমরা কোথা থেকে এলাম। এই একজন মানুষ ঈশ্বরের এক তথ্যে ভুল প্রমাণ করে দিলেন। আমরা স্বর্গ থেকে আসিনি, আমরা স্বর্গেই আছি। এরপর বিজ্ঞানের শাখা প্রশাখায় মানুষ দেখে ফেলল তেরোশো কোটি বছর আগের মহাকাল। যেদিকে তাকাই চেনাজানা মহাকাশ আজ ছাড়িয়ে গেছে চার হাজার ছয়শো কোটি আলোকবর্ষ দূরে। পৃথিবী থেকে দশ লক্ষ মাইল দূরে মানুষের তৈরি ক্যামেরা বসে আছে মহাকাশে, দেখছে, জানছে। মূল কথা হলো অনেক কিছুই জানা হয়নি এখনও, আবার জানা হয়েছে অনেকখানি যা পুরাতনকে মুছে দিচ্ছে একে একে।

পৃথিবীর সমুদ্রপৃষ্ঠে হাজার হাজার দ্বীপপুঞ্জ আছে। গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ কোনো সাধারণ দ্বীপপুঞ্জ নয়। পুরো মানব জাতির এক মৌলিক প্রশ্নের উত্তর মিলেছে এখানে, প্রাণের বিবর্তন। সেই থেকে এই দ্বীপপুঞ্জ আছে অনেকটা সুরক্ষিত, মানুষের বসবাসের আওতার বাইরে। পৃথিবীর অনেক প্রান্তে ভ্রমণ মানে একটা বাকেট লিস্ট। গ্যালাপাগোসের জন্য আমাকে আলাদা বাকেট নিয়ে ঘুরতে হয়েছে অনেক বছর।
প্রশান্ত মহাসাগরে দক্ষিণ আমেরিকার মূল ভূখণ্ড থেকে ১০০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জে আছে মূলত ১৩টি বড় দ্বীপ। ভূতাত্ত্বিক বয়সে এই দ্বীপপুঞ্জের বয়স খুবই কম। মাত্র ৫০ লক্ষ থেকে ১ কোটি বছর আগে পৃথিবীর নাজকা টেকটোনিক প্লেটে জীবিত আগ্নেয়গিরির লাভায় তৈরি এই দ্বীপপুঞ্জ। মূল ভূখণ্ড থেকে হাজার কিলোমিটার দূরে থাকার কারণেই এখানে কোনো উদ্ভিদ বা প্রাণীর আগমন ছিল না দীর্ঘ সময়। ধীরে ধীরে কখনো সমুদ্র জলে ভেসে, কখন আকাশে বাতাসে উড়ে কিছু প্রাণের আগমন ঘটে এই দ্বীপপুঞ্জে। যারাই এসেছে, তাদের ধরন মূল ভূখণ্ডের অন্য প্রাণীদের থেকে আলাদা। দীর্ঘদিন সমুদ্রে ভেসে থাকা কাঠ লতাপাতায় আশ্রয় নিয়ে বা হয়তো দুর্ঘটনাক্রমে এদের আগমন এই দ্বীপপুঞ্জে।
আমরা গ্যালাপাগোস যাবো দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ইকুয়েডরের মূল ভূখণ্ড থেকে। দ্বীপের নাম বাল্ট্রা। দ্বীপটি কমার্শিয়াল এয়ারপোর্ট হিসাবে ব্যবহার করা হয়। দ্বীপে কোনো জনবসতি নেই। মূলত গ্যালাপাগোসের প্রায় সব কটি দ্বীপই জনবসতি শূন্য। সংরক্ষিত আছে প্রাকৃতিকভাবে। এয়ারপোর্টে নেমে ২০ ডলারের রেজিস্ট্রেশন ফি, গ্যালাপাগোস জাতীয় উদ্যানের জন্য ১০০ ডলার ফি দিতে হয়। বাসে চেপে যেতে হয় সমুদ্রঘাটে। মোটর বোটে পাড়ি দিতে হয় ছোট্ট ক্যানেল। ওপাশটাতেই সান্তা-ক্রুজ দ্বীপ। এখানেই জনবসতি। থাকতে হবে এখানেই হোটেলে বা লজে, সেখান থেকে বোটে করে দেখতে হবে বিভিন্ন দ্বীপ।

সান্তা-ক্রুজ দ্বীপে আছে শতাব্দী পেরিয়ে যাওয়া স্থলে থাকা দৈত্যবৎ বিশাল কচ্ছপ। এদের জীবনকাল প্রায় ১৫০ বছর। আমাদের গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ দেখা হয়েছিল মোটর চালিত ক্যাটামারান বোটে। ৮টি কেবিন, ১৬ জন পর্যটক, ক্রু আছেন ৭ জন। সামনের ৪ দিন আমরা ভেসে বেড়াবো প্রশান্ত মহাসাগরের গভীরে গ্যালাপাগোসের এক দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপে। প্রতিটা দ্বীপে প্রাণের বিবর্তন স্পষ্ট এখানে। কিছু দ্বীপ পাখিদের স্বর্গ রাজ্য। এদের ডিম পাড়ার জন্য গাছে নীড় বাঁধার প্রয়োজন পড়ে না। এরা বাসা বাঁধে মাটিতে, পাথরে। তাদের শিকারী বলে নেই অন্য কোনো প্রাণী। আমরা অনেকটা গা ঘেঁষে হেঁটে যাচ্ছি, অথচ ভয় নেই তাদের, উড়ে যাচ্ছে না। অল্প কিছু পর্যটক যারা এখানে আসে তারা তাদের কাছে হুমকি নয়। এ এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা, পাখিদের নিজস্ব ভূমে এতটা কাছ থেকে তাদের কখনো দেখিনি।
দিনের বেলায় দ্বীপে ঘুরে রাত কাটাতে হয় বোটে, ছোট মোটর বোটে এক দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপে যাওয়াটাও একটা চ্যালেঞ্জ। কখনো সমুদ্র উত্তাল, নিদ্রাহীন রাত, আর সী-সিকনেস তো আছেই। বাল্ট্রা, সান্তা-ক্রুজ দ্বীপ পেরিয়ে আমরা দেখেছি সেইমুর, বারটোলোমে, জেনোভেসা, ডারউইন-বে দ্বীপগুলো। প্রতিটা দ্বীপের রহস্য আর সৌন্দর্য তার নিজস্ব। বলা হয়ে থাকে গ্যালাপাগোসের সৌন্দর্যের বর্ণনা করতে যাওয়া ভুল। শুধু কাছ থেকে এসে দেখে যেতে হবে। পৃথিবীর এই ছোট অংশে মানুষের উপস্থিতি, তার আগমন আর বিবর্তন বোঝার জন্য অমূল্য এক স্থান। এখনো এই দ্বীপপুঞ্জ বিবর্তনের জীবিত ল্যাবরেটরি হিসাবে ধরা হয়। আছে এখনো সংরক্ষিত। কিন্তু কতদিন? কেউ জানে না। মানুষ বিবর্তনের এমন এক সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে যেখানে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার মেধা, বুদ্ধি, বিবেচনা মানুষের আছে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে মানুষেরই মাঝে।

গ্যালাপাগোস তোমার আমার অস্তিত্বের রূপকার। মানুষের শত সহস্র লক্ষ বছরের মৌলিক প্রশ্নের জবাব দিয়ে গেছে এই দ্বীপপুঞ্জ। আমি কোথা থেকে এলাম - আপাতত সে প্রশ্নের উত্তর আমাদের অনেকটা জানা, প্রাণের বিবর্তন ধরে আজকে আমরা এখানে, এই সময়ে। ১৬০ বছর আগে, একজন মানুষ মাত্র ২২ বছর বয়সে এই দ্বীপপুঞ্জে এসে যা দেখলেন, যা ভাবলেন, সব বদলে দিলো আমাদের জানা স্বর্গের গল্পগুলোকে। আমরা তো স্বর্গ থেকে আসিনি। আমরা স্বর্গেই আছি। শ্রদ্ধায় আমি নতজানু, প্রকৃতিতে তুমি আমার অবস্থান বলে গেছো, তুমি আর কেউ না, তুমি চার্লস ডারউইন।
Comments