top of page

কাশ্মীর নয় লাদাখই ভূস্বর্গ

  • Writer: Travelograph Partsunknown
    Travelograph Partsunknown
  • Aug 4
  • 3 min read

দক্ষিণে অথই জল। আমি তাকাই উত্তরে, পূর্বে বা পশ্চিমে ভারত। জনসংখ্যায় বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম। অর্থনীতিতে পঞ্চম, আয়তনে সপ্তম।


 Sarmin walks with a Kashmiri horse against the breathtaking backdrop of snow-capped mountains and lush greenery.
Sarmin walks with a Kashmiri horse against the breathtaking backdrop of snow-capped mountains and lush greenery.

বছর বিশেক হলো ভারতীয় সিনেমা, টিভি বা তাদের সংস্কৃতি থেকে দূরে থাকি। অনেকটা এ রকম—কোথাও বেড়াতে গেছি, বসার ঘরে টিভিতে হিন্দি চ্যানেল চলছে, আমি উঠে চলে যাব অন্য ঘরে। আমার সিদ্ধান্ত কোনো অসন্তুষ্টি থেকে নয়, বরং বাঙালি ও ভারতীয় জাতিগত ইতিহাসের টানাপড়েন থেকে। ব্রিটিশশাসন-ভাগের দাগ এখনো কাটেনি আমার ভেতর থেকে।

সঙ্গে আছে একাত্তরের ঘটনা। রাজনৈতিক উত্তেজনা ও সাংস্কৃতিক ভেদাভেদের ছায়ায় ভারত যেন এক রঙিন ছবির সাদা-কালো সংস্করণ আমার কাছে। আমার সীমাবদ্ধতায় জমে থাকা ক্ষোভের প্রতিফলন।


শারমীন আর আমি পাড়ি দিয়েছি এই ছোট গ্রহের সব প্রান্তে। সাত মহাদেশ, ১১৮টি দেশ। ১৭ বছর ধরে। পৃথিবী, তার সৌন্দর্য, শিল্প-সংস্কৃতি, মানুষের বসবাস, চিন্তা-চেতনা, রাজনীতি বা ধর্মীয় অনুভূতিগুলোকে দেখার চেষ্টা করেছি বৃত্তের বাইরে থেকে, নির্মোহ দৃষ্টিতে। সেই সূত্রে একসময় পদার্পণ করলাম ভারতে, কিন্তু দিল্লি পৌঁছে বদলে গেল আগের সব ধারণা।


ইমিগ্রেশনকর্মীর আন্তরিক হাসি। হোটেলের কর্মীদের নম্র কর্মপদ্ধতি। অচেনা দেশে উষ্ণতা পেয়ে ভেঙে পড়ল পূর্বের সব বিবেচনা। ভারত আর ছিল না ভূ-রাজনৈতিক সত্তা, বরং ধরা দিল মানুষের গল্প, হাসি ও মৌন দৃঢ়তার মিশেলে। এখানে ছিল না শুধু ছবি-জলধারা, পাহাড়-উপত্যকা। এ ছিল সময়ের, অনুভূতির, পরিচয়ের এক ভ্রমণ।

Bahar and Sarmin enjoying a sunny day in the lush landscapes of Kashmir with a group of cheerful children.
Bahar and Sarmin enjoying a sunny day in the lush landscapes of Kashmir with a group of cheerful children.

ভারতে আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিল কাশ্মীর। একে ভূস্বর্গ বলে লোকে। সত্যি, হিমালয়ের সাদা চূড়া ও নদীর কলতান হৃদয় ছুঁয়ে যায়। কিন্তু স্বর্গ এখানে শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে আবদ্ধ নয়, এর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মানুষকে দেখলে বোঝা যায়, তাদের জীবন ইতিহাসের যন্ত্রণায় মোড়া। 

সভ্যতার শুরুতে মানুষই সৃষ্টি করেছে মানুষে-মানুষে বিভাজন। সেই বিভাজনের শীর্ষে আজও দাঁড়িয়ে জাতীয়তাবাদ ও ধর্ম। পৃথিবীর বুকে অদৃশ্য কিছু রেখা, একেকটি স্বঘোষিত স্বাধীন দেশ, পতাকার নিচে দাঁড়িয়ে সেই সীমারেখার জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত তার নাগরিকরা। কিন্তু সেই একই ভূখণ্ডে যখন থাকে ধর্মীয় বিভক্তি, কী ঘটে তখন। ধর্ম মানুষকে নিয়ে যায় জাতীয়তাবাদের ঊর্ধ্বে। তৈরি হয় ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতন আর নিপীড়নের গল্প। একই দেশের নাগরিকদের বিভক্তি দেখা যায় পৃথিবীর সব প্রান্তে। আর সেটি দেখার জন্য যেতে হয় না বহুদূর। আমাদের নিজের ঘরে কিংবা পার্শ্ববর্তী দেশেই দেখা মেলে প্রতিদিনের ভয়ংকর চিত্র।


কাশ্মীরে পথের ধারে কথা হলো স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে। আমাদের ট্যুর গাইড, ড্রাইভার—সবাই মুসলমান। আলাপে বুঝলাম ভারতের নাগরিক হয়েও তাঁরা ভারতবিদ্বেষী। ছোট্ট একটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। এই উপনিবেশে ক্রিকেট জনপ্রিয়। কাশ্মীরের বেশির ভাগ মানুষ মুসলিম। ভারত-পাকিস্তান বা আফগানিস্তানের সঙ্গে খেলায় পুরো কাশ্মীর থাকে ভারতের বিপক্ষে। নিজের দেশ, জাতীয়তা সব পেছনে ফেলে চলে আসে ধর্মের আশীর্বাদ বা অভিশাপ। ধর্ম আর জাতীয়তাবাদের লড়াইয়ে মানবিক বন্ধন হারিয়ে যায় ধর্মে। কোন্দল, মারামারি, মানবহত্যার মূল রহস্য এখানেই। দেশভাগের ইতিহাস, বিরোধ, ঔপনিবেশিক দখল—সবকিছুর আঘাত এখানে এখনো তাজা। সেই ব্যথা সারতে লেগে যাবে আরো বহুযুগ।

A joyful moment in the countryside with Sarmin and Bahar, basking in the sunshine while cuddling a gentle lamb amidst lush greenery.
A joyful moment in the countryside with Sarmin and Bahar, basking in the sunshine while cuddling a gentle lamb amidst lush greenery.

কাশ্মীর থেকে আমাদের গন্তব্য লাদাখ। সমধিক নিস্তব্ধ প্রকৃতি। গুলমার্গের দ্য খাইবার হিমালয়ান রিসোর্ট থেকে শুরু করে নুবরা উপত্যকার লাছনাং রিট্রিট রিসোর্ট—প্রতিটি জায়গায় উষ্ণ সম্ভাষণ। আর ছড়িয়ে আছে নির্জনতার অনবদ্য সৌন্দর্য।


পাহাড়, ঘাঁটি, নদী—প্রতিটিরই গল্প আছে। শুনতে কান পাততে হয়। স্থানীয় লোকজনের কথা, হাসি, আবেগের ভাঁজে লুকানো থাকে জীবনের কথা। চীনের পার্শ্ববর্তী অংশ লাদাখ, তিব্বতের মানুষের রূপ, সংস্কৃতি এখানে স্পষ্ট। সন্ধ্যায় স্থানীয় বাজারে মানুষের সমাগম, সকাল পেরোলে পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে যাওয়া মন্দির কিংবা দিনভর গাড়ি নিয়ে ছুটে চলা দূর পাহাড়ের গায়ে। কাশ্মীরের সঙ্গে তুলনায় লাদাখই আমার কাছে ভূস্বর্গ। কখনো কখনো মনে হয় পৃথিবীর যে প্রান্তে মানুষের অনুপস্থিতি, সেটিই স্বর্গ। ভেবে দেখুন, ভ্রমণে আপনি কোথায় যেতে চান। দেখবেন, মন চলে যায় লোকালয়ের বাইরে, বহুদূরে, যেখানে মানুষের ভিড় কম। কারণ? মানুষ মানুষকে নিয়েই বড্ড ক্লান্ত। জীবনের অস্থিরতার মূলে মানুষ নিজেই।



Sarmin walks along the rugged, rocky landscape of Ladakh, India, under a clear blue sky.
Sarmin walks along the rugged, rocky landscape of Ladakh, India, under a clear blue sky.

আমাদের দেশ এখন একটি পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বদলের মধ্যে আমরা এগোচ্ছি কিছুটা এলোমেলোভাবে। অনিশ্চয়তা তো আছেই। এ সময় প্রতিবেশীকে শত্রু হিসেবে দেখাটা হয়তো বোকামি। বড় দেশ, ঘিরে আছে আমাদের চারপাশ, ইতিহাস, সংস্কৃতি, ভাষা—সবই জড়িয়ে আছে একে অপরের সঙ্গে। পার্শ্ববর্তী দেশকে থাকতে হবে পাশে। বাণিজ্য, সংস্কৃতি, শিক্ষা—অজস্র ক্ষেত্রে আমাদের পারস্পরিক সহযোগিতার সুযোগ। মানসিক বাধা ভেঙে আমাদেরও এগিয়ে যেতে হবে। স্বার্থ, শান্তি, উন্নয়নের মানচিত্রে কেবল এভাবেই বদলে যেতে পারি আমরা।


 
 
 

Comments


bottom of page